শরৎকাল : প্রকৃতির সৌন্দর্যমণ্ডিত ঋতু

এখন ভাদ্রমাস; শরৎকাল। শরৎ বাংলার ছয়ঋতুর তৃতীয়টি। গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষার জল মাড়িয়ে আসে শরৎকাল। বাংলা ভাদ্র আর আশ্বিন দু’মাসেই এর আগমন-প্রস্থান। প্রকৃতিতে এক মোহনীয় পরিবর্তন নিয়ে আসে শরৎ। সকালে হালকা কুয়াশায় সিক্ত হয় চারপাশ। ঘাসের ডগায় ঝুলন্ত  শিশির সূর্যের আলোয় চিকচিক করে। দেখতে অনেকটা মুক্তোর মতো।
শরতে রক্তিম সূর্য পূর্ণকিরণ নিয়ে লাল হয়ে উদিত হয় পূবাকাশে। আকাশের কোথাও নেই কালো মেঘ। ছেড়াছেড়া সাদা মেঘের জটলা দূর দিগন্তে উড়ে যায় দূর্বার গতিতে। সারসের দল ক্লান্তিহীনভাবে উড়ে যায় সরোবরের দিকে। নদ-নদী, বিল-ঝিলের তীরে ধবল রঙের কাশফুল ফোটে। বাতাসের ঝাপটায় কাশফুলে ঢেউ তোলে। বিলের ধারে হাটুঁ পানিতে সাদা-লাল শাপলা ফুল ফুটে। চারদিকে সবুজের সমারোহ বিরাজ করে। গাছ-গাছালিতে ফুটে বিভিন্ন রকম ফুল। ফুলের সুবাসে মোহিত হয় চারপাশ। মোটকথা শরৎ যেন প্রকৃতিতে নববধূর রূপ ধারণ করে।
কৃষকের মনে দোলা দেয় এ ঋতু। বর্ষার থরো থরো পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষেতে আমন ধানের চারা রোপন করে তারা। তৈরী হয় নতুন সম্ভাবনার। কৃষক মনের আনন্দে ফসলের পরিচর্যা করে। কাজের ফাঁকে গাছের নিচে গামছা বিছিয়ে ঘুমায়। প্রখর রোদ থাকা সত্বেও ঝিরঝির বাতাস কৃষকের সকল ক্লান্তি দূর করে দেয়। অজান্তে মনের সুখে গান ধরে। কেউবা সৃষ্টিকর্তার শোকর আদায় করে। 
পাড়ার ছেলেরা পুকুর-ডোবার স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটে। প্রবীণ-বুড়োরা বাড়ির সামনে গাছের নিচে বানানো মাচাঙএ বসে আরাম করে। বইপড়–য়ারা ঘরের জানালা খুলে বসে গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বই পড়ে। গৃহবধুরা হাতের কাজ শেষ করে উঠানে বা বারান্দায় নকশি কাঁথা, চাদর, হাতপাখা ইত্যাদিতে বাহারি রংঙের সূতোয় রং-বেরঙের ফুল,  পাখি, প্রজাপতি সহ গ্রামীন জীবনের ছবি আকেঁ। প্রতিটি চিত্রকর্মে ফুটে ওঠে বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখের চিত্র। 
শরতের প্রকৃতি মানবমনকে প্রফুল্ল করে তোলে। কবিরা কবিতা লিখে, ছড়াকার লেখে ছড়া। বাউলেরা গায় প্রকৃতির গান। চিত্রশিল্পী রং-তুলির আচঁড়ে তুলে আনে একখণ্ড সুশোভিত সহাস্য শরৎ। 
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে ছেলে-মেয়েরা দলে দলে নদী, বিল-ঝিলের তীরে কাশবনে বেড়াতে যায়। কাশফুলের পরশে দুই একটা ছবি তোলতে ভুল করেনা তারা। সেই ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে স্মৃতিময় করে রাখে। সন্ধ্যা নামতেই আকাশে বসে তারার মেলা। ছোট-বড় তারায় ঝিকঝিক করে আকাশ। গাঁয়ের মেঠোপথের ধারে আড্ডা দেয় যুবকের দল। দুই-তিন টাকা করে চাঁদা তুলে মুদি দোকানের ভাজা বাদাম আর লবণ নিয়ে গল্প করতে করতে বাদাম চিবায় তারা।  
আশ্বিনের শেষ না হতেই শুরু হয় হেমন্তের আগমনের মাধ্যমে শরৎ বিদায়ের পদধ্বনি। স্বল্প সময়ের অবস্থান যেন মানুষকে জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তিকে দিয়ে যায় অবস্থা পরিবর্তনের পাঠ।
গ্রাম্যসমাজে সামাজিক পরিবর্তনের ফলে বাংলার শরৎ সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে। প্রযুক্তির সংস্পর্শে জনপদের মানুষের প্রকৃতি প্রেম হ্রাস পাচ্ছে। প্রকৃতির বদলে স্থান করে নিয়েছে হাতে হাতে থাকা এন্ড্রয়েড সেটের ভিডিও গেম। ফলে অনেকেই অবসর থাকা সত্বেও প্রযুক্তির বেড়াজালে পড়ে শরতের মতো সুন্দর ঋতুর রূপ-লাবণ্য উপভোগ করতে পারেনা। তবে কেউ উপভোগ করুক আর না করুক শরৎ বারবার ফিরে আসবে প্রকৃতিতে। স্রষ্টার সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য প্রকাশ করতে; আশরাফুল মাখলুকাতের স্রষ্টাকে চেনাতে।