দরদী ও মুখলিস বুযুর্গের সান্নিধ্যে : মাওলানা মুহাম্মদ ঈসা খান

আমার প্রথম ইসলাহী তা'আল্লুক ছিল হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল গণী ফুলপুরী (রহঃ) এর সঙ্গে। ১৩৮১ হিজরীতে আমি তাঁর নিকট বাই'আত হয়েছিলাম। প্রতি রবিবার হযরত ফুলপুরী (রহঃ) এর দরবারে মাহফিল হতো। সেখানে আমি হাজির হতাম। করাচী নাযেমাবাদে এ রকম এক মাহফিলের সময় হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) কে দেখলাম, তিনি কোন ধরনের বিছানা ও ফরাশ ব্যতিত সর্ব সাধারণের সাথে পাকা মেঝের উপর বসে আছেন। সে মাহফিল শেষ হওয়ার পর হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) নিজের মাথার টুপি খুলে মাথা ঝুকিয়ে দিয়ে হযরত ফুলপুরী (রহঃ) কে বললেন حضرت! میرے سر میں دم کر دیکھیئے۔ - হযরত। আমার মাথায় দয়া করে একটা ফুঁ দিয়ে দেন।)

হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) নিজেও তখন অনেক বড় বুযুর্গ। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী (রহঃ) এর স্নেহভাজন খলীফা হিসাবে সমকালীন বুযুর্গগণ সকলে তাঁকে অত্যন্ত সমীহ ও সম্মানের নজরে দেখে থাকেন। এ অবস্থায় তাঁর এই বিনয় ও মিটিয়ে দেওয়ার হালত দেখে আমি দারুনভাবে তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাই। সেদিন আমি হুজুরের নম্রতা ও ফানাইয়্যাত (আত্মলীন হওয়া) কত গভীর তা প্রত্যক্ষ করি। এরপর ১৩৮৫ হিজরীতে আমি হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) এর নিকট বাই'আত গ্রহণ করি। ১৩৯৭ হিজরীতে তিনি আমাকে বাই'আতের এজাযত দান করেন।

বাই'আত হওয়ার পর থেকে হুজুরের জীবনকাল পর্যন্ত রমাযানে হুজুরের সঙ্গে কামরাঙ্গির চরে চিল্লায় থাকতাম। বিভিন্নভাবে তাঁর যতটুকু প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছে তাতে তাঁকে বহু উঁচু স্তরের অন্যতম যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ রূপেই পেয়েছি। ছোট ছোট আচার-আচরণ থেকে নিয়ে বড় বড় বিষয় ও সিদ্ধান্তে তাঁকে সব সময় সুন্নতের অনুসরণ করে চলতে দেখেছি। তিনি সুন্নতের পুরাপুরি পাবন্দ ছিলেন। যদি কোন ব্যক্তি কখনো সুন্নতের কোন কথা স্মরণ করিয়ে দিত তখন খুশী চিত্তে তিনি তা গ্রহণ করে নিতেন।

তিনি যখন রাস্তায় চলতেন নীচের দিকে নজর রেখে চলতেন। এদিক-সেদিক নজর ফেরাতেন না। যিকিরে-ফিকিরে চলতেন। জরুরী কথা ছাড়া তাঁকে কোন কথা বলতে দেখি নি। হরদম পবিত্র কোরআন অথবা যিকিরের ফলে তাঁর যবান মুবারক নড়তে থাকত। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের ঈমানী ও আমলী দূরাবস্থার আলোচনা করে দরদ ও কষ্টের আওয়াযে শ্বাস ফেলতেন। যখন কোন নসীহতের কথা বলতেন, চোখের পানিতে তাঁর চেহারা ভিজে যেত।

তাঁর ইখলাস ও নিঃস্বার্থতা ছিল অনেক উঁচু স্তরের। একবার আমি তাঁর দরবার থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় আমার রাস্তা খরচ আলাদা করে দেখলাম দুইটি টাকা অতিরিক্ত থাকে। সেই দুইটি টাকা আমি হুজুরের সামনে হাদিয়া স্বরূপ পেশ করলাম। হুজুর বার বার বললেন, আপনার তো রাস্তায় কষ্ট হবে। শেষ পর্যন্ত আমার আন্তরিকতা লক্ষ্য করে দুই টাকা হাদিয়া খুশীর সাথে গ্রহণ করে নিলেন। তিনি আমার সামান্য দুই টাকার হাদিয়াকে নিজের শানের খেলাফ মনে করলেন না। বরং মহব্বতের সাথে তা গ্রহণ করে নিলেন। তখন বুঝলাম, হাদিয়ার পরিমান ও টাকার অংকের চেয়ে আন্তরিকতার মূল্য, ইখলাসের মূল্য তাঁর কাছে অনেক বেশী। অনেক বড় একজন মুখলিস বুযুর্গ ছিলেন বলেই হাদিয়া গ্রহণের বেলায় তাঁর মেযাজ এমন ছিল।

একবার এক ট্যানারীর মালিক মাদ্রাসায়ে নূরিয়ার পনেরজন মুদাররিসীন সহ হুজুরকে দাওয়াত করলেন। আমি তখন হুজুরের ওখানে চিল্লায় ছিলাম। মহব্বত করে তিনি আমাকেও সঙ্গে নিলেন। দুইটি নৌকায় করে সকলেই রওয়ানা হলেন।

যাওয়ার পথে হুজুর নৌকায় শুয়ে পড়লেন এবং তাঁর ছোট ছেলে মাওলানা আতাউল্লাহ সাহেবকে মাথার কাছে বসিয়ে বললেন- 'কুরআন শরীফ তেলাওয়াত কর।' আসার পথেও তেমনি হলো। যাওয়া-আসার পথে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত ব্যতীত অন্য কোন কথাই হয় নি।

ট্যানারির মালিক এক ঘরে বসিয়ে সকলকে খাওয়ালেন। খাওয়ার সময় যখন তাঁর বরতনে একটু বেশী বেশী খানা দেওয়ার চেষ্টা হলো, তিনি শুধু হাতে বাধা দিলেন। ট্যানারির মালিক তখন খুবই কাকুতি মিনতির সাথে আরয করলেন যে, 'আপনার বরকত খাওয়ার জন্য সবাই আশান্বিত ও আগ্রহী হয়ে আছে।' হুজুর আর বাধা দিলেন না। তাঁরা হুজুরের বরতন ভর্তি করে ফেললো। তিনি হাত নড়া-চড়া করে অন্য বরতনে হাত সাফ করলেন এবং দু'আ করে চলে আসলেন।

যাওয়া-আসা, খানা খাওয়ার এই দীর্ঘ সময়ে আমি তাঁকে কোন অতিরিক্ত কথা বলতে দেখি নি। শুধু কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করা, তেলাওয়াত শোনা ও যিকির করাই যেন ছিল তাঁর কাজ। খাওয়া-দাওয়া শেষে ফিরে আসার সময় ট্যানারির মালিক হুজুরকে নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে পাঁচশত টাকার একটি নোট খুব কাকুতি মিনতির সাথে হাদিয়া পেশ করলেন। হুজুর নিতে চাইলেন না।

ট্যানারির মালিক ইসরার (বারংবার অনুরোধ) করতে লাগলেন। তিনি মাদ্রাসায়ে নূরিয়ার শিক্ষক মুফতী শামসুল হক সাহেবকে মাদ্রাসার রশিদে উঠিয়ে টাকাটা নিতে বললেন। হাদিয়া দাতা বললেন- হুজুর! এই টাকা আপনাকে হাদিয়া দেওয়ার জন্য বড় আশা করে এনেছি।' তিনি বললেন- 'আমার এত টাকার দরকার নেই।'

শেষ পর্যন্ত মাদরাসার রশিদেই টাকাটা উঠানো হলো। এই ঘটনায় তাঁর সঙ্গে থেকে আমি অনুভব করলাম যে, তাঁর দিলের গতি সব সময় আল্লাহর দিকেই ধাবিত থাকত। দুনিয়ার লোভ-লালসা মোটেও তাঁকে স্পর্শ করে নি।

আরেকটি বিষয় আমার জীবনে একটি বড় অভিজ্ঞতা। বহু জায়গায় আমি গিয়েছি, বহু দেখেছি। কিন্তু হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) এর নামাযকে এক নম্বর সুন্দর নামায হিসাবে পেয়েছি। তাঁর নামাযের হালাতের কোন তুলনা আমি পাই নি অন্য কোথাও।

 

-- মাওলানা মুহাম্মদ ঈসা খান 
মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া, ইসলামপুর, মোমেনশাহী
খলীফা, হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ)

-- হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) স্মারক গ্রন্থ, পৃষ্ঠা- ৩৫৭, ৩৫৮