বাংলাদেশে মিলিটারি ক্যু
সিআইএ লিঙ্ক।
১৯৭১ সালে নয় মাসের এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাংশ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীনতা লাভ করে। জন্ম নেয়- `বাংলাদেশ’। দেশটি স্বাধীন করতে যুদ্ধে অংশ নেয় সর্বস্তরের মানুষ। কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবক। সেই সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা বাঙালি সেনানী ও অফিসারদের সিংহভাগ। সেনাবাহিনীর যেসব বাঙালি সদস্য যুদ্ধ শুরুর সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন তাদের প্রায় সকলে সরাসরি পক্ষ ত্যাগ করে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ভূমিকা নেন বাঙালি সেনা অফিসারগণ। তাঁদের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের এগারোটি সেক্টর। এদের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়া সর্বজন শ্রদ্ধেয় কর্নেল এম এ জি ওসমানী। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য এ সময়ে পালিয়ে আসেন। তারা ওসমানীর নেতৃত্বে এগারোটি সেক্টরের কাঠামোর মধ্যে যুদ্ধে অংশ নিয়ে ভূমিকা রাখেন। সেনা সদস্যদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে রেগুলার ফোর্স। সেক্টর কমান্ডারদের আওতায় ভারতীয় ভূখন্ডে ট্রেনিং দেয়া হয় লক্ষাধিক তরুনকে। তাদের পরিচিতি হয় মুক্তি ফৌজ বা এফএফ। তারা সেক্টর কমান্ডের আওতায় দেশের ভিতরে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই কমান্ড কাঠামোর বাইরে সরাসরি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ -এর প্রধান জেনারেল ওবানের তত্বাবধানে আসামের দেরাদুনে বিশেষ আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে ওঠে। এরা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বাছাই করা সদস্যদের দ্বারা গঠিত। এর নাম দেয়া হয় ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’, সংক্ষেপে বিএলএফ। তাদের পরিচিতি ঘটে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে। তাদের ট্রেনিং হয় বিশেষ সুবিধায়। তারা থাকে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও অধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এমন কি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আওতা ও কর্তৃত্বের উর্ধে। তারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দেশের ভিতরে আসেন ও যুদ্ধে অংশ নেন। এই অবস্থায় ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। তবে তাঁর নেতৃত্ব নিরঙ্কুস ছিল না। একদিকে ভারতীয়রা ‘বিএলএফ’ নামে আলাদা বাহিনী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে যায়। তাদের অনেক বিষয়ই তাঁর অজানা থাকে। পাশাপাশি তিনি নিজ মন্ত্রিসভা ও দলের মধ্য থেকেও বিভিন্নমুখী অপতৎপরতার সম্মুখীন হন। মন্ত্রিসভায় প্রবীন নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তারা পাকিস্তানের সাথে সমঝোতা করে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করার পক্ষে ছিলেন। অপরদিকে দলের যুব অংশের নেতা শেখ ফজলুল হক মনিসহ অনেকেই আগাগোড়া তাজউদ্দিন বিরোধী ছিলেন। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই অবশেষে দেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবাসী সরকারের মধ্যকার ঐ অন্ত:র্দ্বন্ধের রেশ রয়েই গেল। সেই সাথে যোগ হলো নতুন দেশের নতুন সেনাবাহিনীর বিষয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করে লড়াইয়ের অংশ নেয়া সেনাদের সাথে এসে যোগ দিলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কিছুদিন পরে স্বদেশ প্রত্যাগত পাকিস্তানী বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। এই দুই ধারার মধ্যে এক ধরণের অস্বস্তি তৈরি হয়ে রইলো। উপরন্তু, সেনাবাহিনীর সমান্তরালে প্যারা-মিলিশিয়া ‘রক্ষী বাহিনী’ গঠন আরেক অসন্তোষের কারণ ঘটায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে অভাবনীয় জাতীয় আকাঙ্খার জন্ম হয়েছিল তা পূরণ না হওয়ার কারণে সদ্য স্বাধীন দেশটির প্রথম দশক উম্মাতাল এক সময়কাল হিসেবে দেখা দেয়। ১৯৭০-এর দশক হচ্ছে এই সময়কাল।এই খুব সিগ্রই সময়কালে এমন কতগুলো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে যা দেশটিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। এসব ঘটনার মধ্যে তিন তিনটি সেনা অভ্যুত্থান অন্যতম। আমেরিকান সাংবাদিক-লেখক বি জেড খসরু ইংরেজিতে লেখা তাঁর এই বইয়ে আমেরিকান গোপন কুটনৈতিক দলিল দস্তাবেজ এবং ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণাদি থেকে বাংলাদেশের এই সময়কালকে গভীর বিশ্লেষণে উপস্থাপন করেছেন। বাংলাভাষাভাষী পাঠকের কাছে তাঁর এই বর্ণনা সহজভাবে তুলে ধরতেই আমার এই প্রয়াস। আমি আশা করি তাঁর গ্রন্থের এ অনুবাদ পাঠক নন্দিত হবে। বেশ কিছু অজানা তথ্য পাঠক জানতে পারবেন এ থেকে। নতুন প্রজন্মের ইতিহাস অধ্যয়ন ও চর্চায় তা নিশ্চয়ই সহায়ক হবে।