বই : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে রাজনীতি ও তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজ

প্রকাশনী : দ্যু প্রকাশন
মূল্য :   Tk. 500.0   Tk. 375.0 (25.0% ছাড়)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২১ সালে। আর দু'বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়টি শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিগত যুগের রােমান্টিক কোনাে কাহিনি নয়। এর সঙ্গে সরাসরি অঙ্গাঙ্গি হয়ে আছে সেকালের বঙ্গীয় সমাজের দুঃখময় সমাজচিত্র। সেই সময় বঙ্গীয় সুশীল সমাজের একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মধ্যদিয়ে পূর্ববঙ্গ নামে নতুন একটি প্রদেশ গঠন করা হয়। ঢাকাকে করা হয়েছিল পূর্ববঙ্গের রাজধানী। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের এই ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সেকালে সারস্বত সমাজের বিরােধিতার কারণে সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। নবসৃষ্ট পূর্ববঙ্গ প্রদেশটি আর টিকল না। ঢাকা হারাল প্রদেশিক রাজধানীর মর্যাদা।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে অবহেলিত মুসলমান সমাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, তার ফলশ্রুতিতে খুব দ্রুত পূর্ববঙ্গের অবহেলিত ও পশ্চাদপদ মুসলমান সমাজভুক্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বিশেষ সুযােগ সৃষ্টি হয়।

বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনের ফলে ১৯১১ সালে পূর্ববঙ্গ নামে নতুন প্রদেশ বিলুপ্ত হলেও পূর্ববঙ্গের মানুষের শিক্ষা গ্রহণের সুযােগ আদৌ যেন বন্ধ না হয়, সেজন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে পূর্ববঙ্গের মানুষের শিক্ষার সুযােগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের নিকট পূর্ববঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আবেদন জানান। এই আবেদনের প্রেক্ষিতেই সরকার পূর্ববঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিল।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বিশেষ মহল অপতৎপরতা শুরু করে এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ড. রাসবিহারী ঘােষের নেতৃত্বে একটি দল ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তারা তাদের ক্ষোভের কথা জানান। তারা বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গ কৃষিপ্রধান দেশ। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে কোনাে লাভ হবে না। কারণ, ড. রাসবিহারীদের মতাে মানুষের নিকট পূর্ববঙ্গের মানুষ কৃষকসমাজ হিসেবেই চিহ্নিত ছিল।

এম এ রহিম লিখেছেন –

The Hindu leaders were opposed to the plan of setting up a University at Dacca. They voiced their disapprobation in press and platform. On February 16, 1912 a delegation headed by Dr. Ras Behary Ghosh waited upon the Viceroy and expressed apprehension that the creation of a separate University at Dacca would be in the nature of an internal patition of Bengal. They also contended that "the Muslims of Eastern Bengal were in large majority cultivators and they would benefit in no way by the foundation of a University".

তারপর বঙ্গীয় সমাজে অনেক ঘটনাই ঘটেছিল এবং তার প্রায় সবই ছিল খুবই অনভিপ্রেত এবং অপ্রত্যাশিত। পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতি যে অবহেলার নজির স্থাপন করেছিলেন সেকালের বাংলার একটি অংশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সেসব কাহিনি পড়লে বিস্ময় না জেগে পারে না! তারা বলতেন, পূর্ববঙ্গের মানুষের মধ্যে একটি বড় অংশ হলাে চাষি সম্প্রদায় –

“The Muslims of Eastern Bengal were in large majority cultivators and they would benefit in no way by the foundation of a University.'

তাই মুসলমানদের জন্য এখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে কোনাে লাভ হবে না। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এগিয়ে আসেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। ওই আন্দোলনের সঙ্গে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীসহ আরও অনেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এ কে ফজলুল হকও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯১৩ সালের ৪ এপ্রিল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ইংরেজিতে তিনি যে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন তার কিছু অংশের বঙ্গানুবাদ—

আমি পূর্ব বাংলার শিক্ষার ক্ষেত্রে অনগ্রসরতার কারণ দূরীকরণের প্রয়াস বা মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের কেন্দ্রে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অপরিসীম গুরুত্বের বিষয়টি ছােট করে দেখতে চাই না। কিন্তু আমি এই তত্ত্বের প্রতিবাদ করি যে এই বিশ্ববিদ্যালয় কেবলমাত্র মুসলমানদের খুশি করার জন্য করা হচ্ছে। ভাইসরয় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সমান সুযােগ সুবিধার জন্য স্থাপন করা হচ্ছে।

বর্তমান গ্রন্থে সেকালের বঙ্গীয় সমাজের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলি বিধৃত করা হয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামাজিক ও মানসিক ক্ষেত্রে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, স্বল্পকথায় তার ঐতিহাসিক বিবর্তনের রেখাচিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষ-সমাজের মনােজগতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যেসব তথ্য বর্তমান গ্রন্থে আলােচনা করা হয়েছে, সেসব আদৌ কাল্পনিক নয়। বক্তব্যের সপক্ষে যত দূর সম্ভব তথ্যপ্রমাণ যুক্ত করা হয়েছে। ইতিহাসের যাত্রাপথের সব গান বিশেষ কোনাে ধারায় রচিত হয় না। অতীত প্রেক্ষিত অজানা থাকলে ইতিহাসের মূলধারা অনুসন্ধান করাও যায় না। সামাজিক ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনার রেখা টানতে হলে তার বিশ্লেষণও প্রয়ােজন। অন্যথায় পাঠকের কাছে ইতিহাসের ঘটনাবলি একটি গল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। ইতিহাস গল্প নয়। অন্য অর্থে ইতিহাস ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার একটি নিখাদ আলেখ্য। জনজীবনের বিভিন্ন কাহিনি পাঠ করার পর পাঠকের মনে যে কম্পন সৃষ্টি হয়, তার তরঙ্গ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, ইতিহাসের মূল দর্শন তার ভেতরে যদি সঞ্চার করা সম্ভব হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির পর পূর্ববঙ্গের সমাজ ও সংস্কৃতির অভ্যন্তরে যে নবতরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল, তার ফসল হলাে বাংলাদেশ কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী সমাজ। আরও গভীরে প্রবেশ করলে বলতেই হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অভিযাত্রার সড়কটি প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, ১৯৭১-এর মুক্তি সংগ্রামে জীবনদান করে।

গ্রন্থটি লেখার সময় আমার স্ত্রী শাপলা শিরিন (অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে একাধিক দুর্লভ বই সংগ্রহ করে দিয়েছেন। আমার কন্যা ফারহানা তাবাসসুম প্রিয়ম প্রয়ােজনীয় তথ্য নিজ হাতে কপি করে দেয়ায় তথ্য সংযুক্তির ক্ষেত্রে আমার শ্রম অনেকটাই লাঘব হয়েছে। কাজী মুহম্মদ আরিফ গ্রন্থটি লেখার সময় ব্যক্তিগত উদ্যোগে মূল্যবান কিছু গ্রন্থ সংগ্রহ করে দিয়ে আমায় ঋণী করেছেন। ঢাকা কলেজের দর্শন বিভাগের ছাত্র স্নেহভাজন মাের্শেদ হালিম পাণ্ডুলিপি পরিমার্জনের সময় সময় দিয়ে আমায় আমার শ্রম লাঘব করতে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। অনেক লেখকের গ্রন্থ থেকে রসদ সংগ্রহ করে বর্তমান গ্রন্থে ব্যবহার করেছি—তাঁদের সবার প্রতি আমি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা জ্ঞাপন করছি।

এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের কালপরিধি ১৯০৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯২১ সালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ১৯০৫ সালে সংঘটিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং ১৯২১ সালে শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। ১৯০৫ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত উল্লেখযােগ্য প্রায় সব ঘটনা স্বল্প কথায় গ্রন্থভুক্ত করা হয়েছে। ১৯২১ সালের পরবর্তী কোনাে ঘটনা গ্রন্থভুক্ত না করার পক্ষে যুক্তি এই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির পরবর্তী যুগের ইতিহাস অল্পবিস্তর অনেকেই জানেন। ১৯০৫ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজের অনেক তথ্য বর্তমানে স্মৃতিবিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেছে। যে কারণে এই অংশটির ওপর বিশেষ গুরুত্বারােপ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রসঙ্গে আলােচনার সময় ১৯২৬-২৮ সাল পর্যন্ত কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ওটুকু করা হয়েছে প্রয়ােজনের তাগিদেই। গ্রন্থটির ওপর পাঠকদের তরফ থেকে সুচিন্তিত অভিমত প্রত্যাশা করছি। দ্যু প্রকাশন গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্যদিয়ে আমায় কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।

বইয়ের নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে রাজনীতি ও তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজ
লেখক শেখ মাসুম কামাল  
প্রকাশনী দ্যু প্রকাশন
সংস্করণ প্রথম প্রকাশ, ২০১৯
পৃষ্ঠা সংখ্যা 237
ভাষা বাংলা

শেখ মাসুম কামাল