রচনাসংগ্রহ ১ম খণ্ড
নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে আমরা এবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করলাম। পরিবর্তমান এই বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়া বা এর মোকাবেলায় আমাদের আশু কর্তব্য একটি স্বাধীন, স্বাবলম্বী ও মর্যাদাবান জাতি বিনির্মাণ করা। এর জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্রের চর্চা, আইনের শাসন, এবং সর্বোপরি জাতিসত্তার বিকাশ। বিগত অর্ধশত বছরে অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী, বশংবদ ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি, আত্মকলহ এবং সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব এতে বাধা সৃষ্টি করেছে। বিশেষত জাতিসত্তার বিকাশ দিশা হারিয়েছে বারবার। আমাদের বুদ্ধিজীবি সমাজ এক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে শুধু যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তাই নয়, বরং অধিকাংশ সময় তারা এসব অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ডের সক্রিয় অংশীদার হয়েছেন। তবে আশার কথা একেবারেই হাতে গোণা হলেও কয়েকজন বুদ্ধিজীবি এই বশংবদ বুদ্ধিবৃত্তিক স্রোতোধারার বাইরে থেকে জাতিকে লক্ষ্যাভিমুখী করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ এদের মধ্যে অন্যতম। ড. সামাদ একজন বহুমাত্রিক জ্ঞানসাধক, আপসহীন বুদ্ধিজীবী এবং দেশপ্রেমিক লেখক। তিনি জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আমাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার পরিচয়কে তুলে ধরেছেন বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। একজন সচেতন ও দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে স্বদেশের স্বার্থের প্রশ্নে আপসহীন ভূমিকা রেখেছেন সব সময়। তাঁর কলম বিচিত্র পথের অনুগামী হয়েছে। বিজ্ঞান, শিল্পকলা, দর্শন, নৃতত্ত্ব, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি- সবক্ষেত্রেই তাঁর অবাধ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ। মানুষ ও স্বজাতির তীব্র কল্যাণচেতনায় তিনি ক্রমাগত চিন্তাশীলতা ও অনুসন্ধিৎসার আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর জ্ঞানচর্চা ও লেখালেখির ক্ষেত্র বিচিত্র হলেও তার প্রধান অভিমুখ ছিল বৃহত্তর অর্থে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় অনুসন্ধান, উন্মোচন ও বিকাশ এবং বিশেষত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বার্থ, স্বকীয়তা ও মর্যাদা অর্জন ও রক্ষার বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। কিন্তু তিনি সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ বা সম্প্রদায়কেন্দ্রিক মানসিকতাকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি সবকিছুকে দেখেছেন ও বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানসম্মতভাবে। যৌক্তিক, বৌদ্ধিক, ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, ভাষিক ও সাহিত্যিক মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে ড. সামাদ প্রমাণ দিয়েছেন বাঙালি মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার অধিকারী। তার সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্ব এবং উন্মেষ ও বিকাশে বহু জাতির মিশ্রণ ও ভূমিকা থাকলেও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাঙালি মুসলমান একক ও স্বাধীন সত্তায় উজ্জ্বল। তার আদর্শ, বিশ্বাস, জীবনচেতনা, রীতি-নীতি, প্রকাশভঙ্গি, শিল্পচেতনা, সর্বোপরি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের একটা পৃথক ইতিবৃত্ত আছে। ফলে একটা আলাদা জনসমাজ গড়ে উঠেছে ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহৎ জনসমাজে। সে পথেই বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবোধ ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ঘোষণার বাসনা জাগ্রত ও লালিত হয়েছে এবং তার থেকেই অভ্যুদয় ঘটেছে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। অতএব এর অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই জাতীয়তাবোধের লালন ও বিকাশের ওপর। দেশপ্রেম এবং স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তির এমন সম্মিলন বাংলাদেশে বিরল। তাঁর এসব পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ছড়িয়ে আছে তাঁর অসংখ্য গ্রন্থ, প্রবন্ধ, কলাম এবং অন্যান্য রচনায়। ড. সামাদের রচনাসম্ভার বিপুল এবং বিচিত্র। তাঁর কয়েকটি বই আমরা ইতোপূর্বে প্রকাশ করেছি। একটি ‘নির্বাচিত রচনাসংগ্রহ’ প্রকাশের ব্যাপারেও আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি সম্মতি প্রদান করেছিলেন। আমরা কাজও শুরু করেছিলাম। ইতোমধ্যে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সকল মহল থেকে দাবি ওঠে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ এবং অগ্রন্থিত রচনাগুলো একত্র করে রচনাসমগ্র প্রকাশ করা হোক। এটা আমাদের জন্য একটি দুরূহ কাজ। তবুও আমরা উদ্যোগী হয়েছি প্রথমত ড. সামাদ এবং তাঁর শুভানুধ্যায়ী ও ভক্তদের আগ্রহকে সম্মান প্রদর্শন করার জন্য, এবং সর্বোপরি তাঁর রচনাবলী বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও মর্যাদাবান জাতি গঠনের লড়াইয়ে রসদ জোগাবে এই প্রত্যাশায়। দীর্ঘকাল ধরে লেখা ড. সামাদের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত বিপুল রচনাবলীর মধ্য থেকে বর্তমান ‘রচনাসংগ্রহ ১’-এর জন্য আমরা বেছে নিয়েছি বায়ান্ন থেকে একাত্তর, বাংলাদেশে ইসলাম এবং বাংলাদেশ: সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ও বেশকিছু অগ্রন্থিত রচনা। এসব গ্রন্থ ও রচনার মধ্যে পাঠক ড. সামাদের গভীর জ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠা এবং দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠার পরিচয় পাবেন।
বইয়ের নাম | রচনাসংগ্রহ ১ম খণ্ড |
---|---|
লেখক | এবনে গোলাম সামাদ |
প্রকাশনী | পরিলেখ প্রকাশনী |
সংস্করণ | |
পৃষ্ঠা সংখ্যা | |
ভাষা |