সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ-এর ইস্তাম্বুল বিজয়
কনস্টান্টিনোপলের ৩ দিকে জলসীমা থাকায় স্থলভাগেই আক্রমণ শুরু করে উসমানীয় বাহিনী। গোল্ডেন হর্ন গুরুত্বপূর্ণ একটি সমুদ্রবন্দর। এদিক আক্রমণের ভয়ে গোল্ডেন হর্নের মুখে শিকল দিয়ে আটকে দেয় বাইজেন্টাইন বাহিনী। এতে করে উসমানীয় নৌবাহিনী বসফরাস প্রণালি দিয়ে গোল্ডেন হর্নে ঢুকতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়।
গোল্ডেন হর্নে শিকল দিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করার পর স্থলভাগে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে উসমানীয়দের প্রতিহত করতে থাকে বাইজেন্টাইন বাহিনী। এতে করে কনস্টান্টিনোপলের দুর্ভেদ্য প্রাচীর কোনোভাবেই অতিক্রম করতে পারছিলেন না উসমানীয়রা। সুলতান মুহাম্মাদের একের পর এক রণকৌশল খুব সফলভাবেই ভেস্তে দিচ্ছিলো বাইজেন্টাইন বাহিনী।
স্বপ্নে আবু আইয়ুব আনসারী (রাযি.):
লাগাতার অবরোধ করে কনস্টান্টিনোপল দখল করতে না পেরে একরকমের অস্বস্তিবোধ করছিলেন উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ। সেনাদের ক্লান্তি ও লাশের সারি ক্রমাগত দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন সুলতান। তখন কিছুদিন তিনি আধ্যাত্মিক ধ্যানে মশগুল থেকে আল্লাহর কাছে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের জন্য দু’আ করতে থাকেন। এর মধ্যে তিনি স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবী হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাযি.) কে দেখতে পান। তিনি সুলতান মুহাম্মাদকে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের অনুপ্রেরণা যোগান এবং কনস্টান্টিনোপলের অদূরে নিজ কবরের সন্ধান দেন। পরবর্তীতে স্বপ্নে নির্দেশিত স্থানে মাটি খুঁড়ে আবু আইয়ুব আনসারী (রাযি.) এর কবরের বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
সুলতান মুহাম্মাদের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ও কনস্টান্টিনোপল বিজয়:
আগেই বলা হয়েছে গোল্ডেন হর্নের মুখে শিকল দিয়ে বাধা দেওয়ার কারণে শুধু স্থলভাগেই আক্রমণ সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে উসমানীয়দের। গোল্ডেন হর্নের দিক থেকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে সুলতান মুহাম্মাদ এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্থলপথে জাহাজ চালিয়ে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিলেন।
তিনি রাতের আধারে গাছের টুকরোয় চর্বি দিয়ে পিচ্ছিল করে তাতে ৮০ টি রণতরী বসফরাস থেকে প্রায় ১০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে গোল্ডেন হর্ন সমুদ্র বন্দরে নিয়ে আসেন।
অবশেষে গোল্ডেন হর্ন ও স্থলভাগ দুদিকেই আক্রমণের সুযোগ তৈরি করে উসমানীয়রা। বাইজেন্টাইনরা টের পেয়ে গোল্ডেন হর্নে সেনা মোতায়েন করলে অন্যদিকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
২৮ মে ১৪৫৩ ঈসাব্দের রাতে সুলতান মুহাম্মাদ কনস্টান্টিনোপলে চূড়ান্ত হামলার ঘোষণা দেন। ২৯ মে সকালে উসমানীয়দের একের পর এক হামলায় পর্যদুস্ত হয় বাইজেন্টাইন বাহিনী। সেসময় সাধারণ মানুষ এমনকি নারীরা পর্যন্ত উসমানীয়দের প্রতিহত করতে রণক্ষেত্রে নেমে আসে।
দুর্গের প্রাচীর ভেদ করার পর সুলতান মুহাম্মাদ তার বিশেষ জেনিসারি বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাদের অন্যতম বীর সেনা হাসান আগা বীরত্বের সাথে বাইজেন্টাইন সেনাদের প্রতিহত করে দুর্গে উসমানীয়দের চাঁদ খচিত পতাকা উড্ডীন করতে সক্ষম হোন। কথিত আছে সেন্ট রোমান্স (বর্তমানে তোপকাপি প্রাসাদ) এর উপর সর্বপ্রথম উসমানীয় প্রতাকা উড্ডীন হয়। দুর্গে পতাকা দেখে উসমানীয়দের স্পৃহা বেড়ে যায় এবং তারা অগ্রসর হলে যুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ হয়ে যায়।
রোমান সম্রাট কনস্টাইন আসন্ন পরাজয় দেখতে পেয়ে নিজের বিশেষ রাজকীয় পোশাক খুলে যুদ্ধে আবর্তিত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে ১১শ বছরের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে এবং মুসলমানদের জন্য এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়।
২৯ মে সুলতান মুহাম্মাদ বিজয়ী বেশে কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করেন। তিনি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তিনি নারী- শিশুদের প্রতি যে দয়া দেখিয়েছেন তা খৃষ্টান ইতিহাসবিদরাও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
সুলতান মুহাম্মাদ শহরের নাম পরিবর্তন করে ইসলাম বুল তথা ইসলামের শহর রাখেন। পরবর্তীতে তা পরিবর্তন হয়ে বর্তমানের ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত। তিনি তার সাম্রাজ্যের রাজধানী আন্ড্রিয়ানোপল থেকে ইস্তাম্বুলে স্থানান্তরিত করেন। তখন থেকে তিনি মুহাম্মাদ আল ফাতিহ তথা বিজেতা মুহাম্মাদ নামে পরিচিত।
বইয়ের নাম | সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ-এর ইস্তাম্বুল বিজয় |
---|---|
লেখক | এনামুল করীম ইমাম |
প্রকাশনী | মাকতাবাতুস সুন্নাহ (বাংলাবাজার) |
সংস্করণ | প্রথম প্রকাশ, ২০২১ |
পৃষ্ঠা সংখ্যা | 192 |
ভাষা | বাংলা |