বাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ (১৮৮৫-১৯২১)
বাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ (১৮৮৫-১৯২১) বইটির অবতরণিকা:
অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক জয়ের মাধ্যমে যে শাসন ব্যবস্থা ভারতবর্ষে চালু হয়েছিল কালক্রমে তা আরও সুসংহত হয়। ১৭৫৭-১৮৫৭ সাল সময়ে সনাতন বা মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা প্রসূত মূল্যবোধের সাথে এবং কোম্পানি শাসনের সৃষ্ট মূল্যবোধের অঘোষিত সংঘাত চলতে থাকে। কোম্পানি শাসন ও ১৮৫৭ সাল পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে শাসিত বাংলায় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে আসে বিবর্তন। সনাতন শ্রেণীসমূহ পুরনো মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরলেও সমাজের নতুন শ্রেণীসমূহ অচিরেই সমাজে প্রাধান্য বিস্তার করে। ব্রিটিশ প্রশাসন এদেশের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছিল অথবা শোষকরূপে কাজ করেছিল তা নিয়ে মত পার্থক্য আছে। তবে ইউরোপীয় ধাঁচের প্রশাসন এবং শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজে যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভূমি সংস্কার, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্পায়ন ইত্যাদি যেমন সমাজ পরিবর্তনে সাহায্য করেছে তেমনি উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত শিল্পপণ্যের বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে এদেশের কুটির শিল্প ধ্বংস করা হয়। প্রায় দই শত বছর ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের মাধ্যমে এদেশের পুঁজি ইংল্যান্ডে পাচার করা হয়। অবশ্য এদেশের অর্থনৈতিক শোষণের বিষয়টি এই গ্রন্থের উপজীব্য নয়। বরং ব্রিটিশ প্রশাসনিক পদক্ষেপসমূহের প্রভাবে সৃষ্ট ইংরেজি শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক পটভূমি সন্ধান করাই হলো এই গ্রন্থ রচনার প্রাথমিক লক্ষ্য।
১৮৮৫ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সাথে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকশিত হতে শুরু করে। বলাবাহুল্য যে, হিন্দু সমাজে ১৮৩০- এর দশকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আত্মপ্রকাশ করলেও মুসলিম সমাজে তা বিলম্বিত হয়। মূলত ১৮৭০-এর দশক থেকে মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্য সরকারি পদক্ষেপ ও মুসলিম সমাজপতিদের ইতিবাচক ভূমিকার কারণে মুসলিম সমাজে ধীরে ধীরে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হতে থাকে। ইংরেজি শিক্ষিত মুসলিম তরুণেরা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্তি লাভের মাধ্যমে সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আত্মপ্রকাশে সহায়তা করে।
এই গ্রন্থটি পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে শ্রেণী সংজ্ঞা (মধ্যবিত্ত), শ্রেণী চরিত্র ও বাংলায় এই শ্রেণীটি বিকাশের পটভূমি ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে। মুসলিম সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আত্মপ্রকাশ অনুসন্ধানের জন্যেই এই প্রয়াস নেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থান উনিশ শতকের পটভূমিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সনাতন শ্রেণীসমূহ কিভাবে অবক্ষয় প্রাপ্ত হলো এবং অবক্ষয়ের 'মাঝেও কিভাবে নতুন সামাজিক শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল তার অন্বেষণ করা হয়েছে।
তৃতীয় অধ্যায়ে মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার সূচনা ও প্রসারের ক্ষেত্রে কি কি বাধা কাজ করেছিল তা যেমন ব্যাখ্যা করা হয়েছে তেমনি ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের তথ্যাদি বিভিন্ন সারণি দ্বারা দেখানো হয়েছে। এই অধ্যায়টির মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি মুসলিম সমাজে প্রতিক্রিয়া ও সাড়া দেয়ার বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে বলে ধারাণা করা যায়।
চতুর্থ অধ্যায়ে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আর্থিক পটভূমি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সমাজে একটি নতুন শ্রেণী আত্মপ্রকাশে অর্থনৈতিক উপাদান কতটুকু সাহায্য করেছিল তা দেখানো হয়েছে। পাট চাষ অথবা পাট শিল্প মুসলিম সমাজের আর্থিক উন্নতির ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছিল তা বিভিন্ন প্রাথমিক উপাদান ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে। বস্তুত আর্থিক স্থবিরতা কাটিয়ে মুসলিম সমাজ ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে ব্রতী হওয়ার অর্থনৈতিক পটভূমি এই অধ্যায়ের মূল বিষয় হিসেবে আলোচিত হয়েছে।
পঞ্চম অধ্যায়ে বিকশিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনীতি ও সমাজ ভাবনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই শ্রেণীটি সংবাদপত্র প্রকাশের মাধ্যমে অথবা সংবাদ-সাময়িকপত্রে তাদের চিন্তা-চেতনা প্রকাশ করেছেন। মুসলিম সমাজের উন্নতি ও রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা দেয়ার জন্য এই
শিক্ষিত শ্রেণীটির কর্মতৎপরতা বিশ শতকের শুরুতে সমাজে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ফলে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাত দেখা দেয়। এই সংঘাতের মাঝেও সমাজকে এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব দৃঢ়তার সাথে বিবেচনা করেছে এবং বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। এই অধ্যায়ে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
এই গ্রন্থ রচনায় আমি মূলত বিভিন্ন সরকারি রিপোর্ট, পত্র-পত্রিকা, সাহিত্যনির্ভর উপাদান ব্যবহার করেছি। তাছাড়া এই অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন গবেষকের গ্রন্থাবলিও এখানে ব্যবহৃত হয়েছে। সরকারি রিপোর্ট, পত্র-পত্রিকা, গ্রন্থাবলির তালিকা ও প্রাসঙ্গিক পরিশিষ্ট গ্রন্থের শেষে যুক্ত করা হয়েছে।
১৯৯৫ সালে আমার এই গবেষণা গ্রন্থটি বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে। প্রকাশিত হওয়ার পর এটি সুধী সমাজে প্রশংসিত হয় এবং সমাজ বিষয়ক একাডেমীক জার্নাল 'সমাজ নিরীক্ষণ' এ আসাহাবুর রহমান লিখিত প্রবন্ধে উচ্চ প্রশংসিত হয়। (মার্চ '৯৭)। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টাডিজ সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের গবেষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রন্থটি বেশ পরিচিতি পায়। প্রথম সংস্করণের সকল কপি এগার বছর আগে বিক্রি হয়ে গেলেও বাংলা একাডেমী দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করে। গবেষক ও শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে আমি খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী জনাব কে এম ফিরোজ খানকে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য অনুরোধ করি। তিনি এটি প্রকাশ করে আমাকে বাধিত করেছেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
-- গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া
বইয়ের নাম | বাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ (১৮৮৫-১৯২১) |
---|---|
লেখক | ড. গোলাম কিবরিয়া ভুঁইয়া |
প্রকাশনী | খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি |
সংস্করণ | প্রথম প্রকাশ, ২০১৩ |
পৃষ্ঠা সংখ্যা | 191 |
ভাষা | বাংলা |