আল – কুরআন আমাদের কথা বলে
আমার বয়স যখন নয় কি দশ বছর তখন থেকেই কালামে পাকের অধ্যয়নে হাতে খড়ি। তখন থেকেই আল-কুরআনকে বুঝার আগ্রহ একটু একটু করে মনে সৃষ্টি হতে থাকে। যেহেতু আমার আব্বা একজন আলেম ছিলেন তাই আমাদের বাসার পরিবেশটাও ছিল তার অনুকূলে। আমাদের বাসায় বেশ কয়েকটি তাফসির গ্রন্থ,সিহাহ্-সিত্তার সকল হাদীস গ্রন্থসহ অনেক ইসলামী বই পুস্তকে দু’টি বড় আলমারী ভর্তি ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রায় সকল কিতাবই ছিল আরবি ও উর্দু ভাষায় লিখা। কিছু কিছু বাংলা বইও ছিল তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। একখানা বাংলা “শব্দে শব্দে অনুবাদের কুরআন”ও ছিল কিন্তু এর দ্বারা আল-কুরআনের বক্তব্য বুঝতে পারছিলাম না। তাই প্রতিদিনই আব্বাকে এ ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন করতাম। তিনিও বোধগম্য ভাষায় তা বুঝিয়ে দিতেন। এদিকে আল-কুরআনের প্রতি আমার আগ্রহ দেখে আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে শহরের একমাত্র ক্বাওমী মাদরাসায় ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু মাদরাসায় কুরআন পড়ানো হবে তো আরো দশ-বারো বছর পর একথা আব্বাকে বললে তিনি বাংলা ভাষায় লিখা একখানা তাফসির গ্রন্থ কিনে দিলেন। তখন থেকেই মূলত আল-কুরআনের তাফসির পড়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। জীবনের এক পর্যায়ে এসে আরবি এবং উর্দু ভাষায় কুরআনের অনুবাদ ও বেশ কয়েকখানি তাফসিরগ্রন্থ পড়তে হয়েছে। কিন্তু ছাত্র জীবন শেষেও সেই অভ্যাসটি অটুট ছিল। জীবন সংগ্রামের ব্যস্ততায় পূর্বের ন্যায় সময় দিতে না পারলেও প্রায় প্রতি দিনই কিছুনা কিছু অধ্যয়নের অভ্যাস চালু ছিল। এরই মধ্যে আমার বিয়ে অনুষ্ঠানে কিছু সংখ্যক ভাই সাইয়্যেদ কুতুব শহীদের লিখা বিখ্যাত তাফসির “তাফসির ফি যিলালিল কুরআনের বাংলা অনুবাদ” এই মহা মূল্যবান গ্রন্থখানি দিলেন। ইতপূর্বে এ গ্রন্থখানি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়ে উঠেনি। কিন্তু কঠিন এ ব্যস্ত জীবনে গ্রন্থখানি পড়ে শেষ করতে অনেক সময় লেগে যায়। তবে এ তাফসিরটির ভূমিকাটুকু পড়ার পরই আল-কুরআন সম্পর্কে ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গী আমার অন্তরে জেগে ওঠে। তা হলো আল-কুরআনে নিজেকে খোঁজার আগ্রহ। তা এজন্য যে,এর সম্পাদক কিতাবটির ভূমিকাতে আহনাফ বিন কায়েস (রহ) সম্পর্কে এক ঐতিহাসিক গল্পের উল্লেখ করেছেন,যা তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ)-এর রচনা থেকে সংগ্রহ করেছেন। আমি সেই গল্পটি হুবহু আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আহনাফ বিন কায়েস নামক একজন আরব সর্দারের কথা বলছি। তিনি ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। তাঁর সাহস ও শৌর্য ছিল অপরিসীম। তাঁর তলোয়ারে ছিল লক্ষ যোদ্ধার জোর। ইসলাম গ্রহণের পর নবী (সা)-কে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি,তবে নবীর (সা)-এর বহু সাথীকেই তিনি দেখেছেন। এঁদের মধ্যে আলী (রা)-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। একদিন এক ব্যক্তি তাঁর সামনে কুরআনের এই আয়াতটি পড়লেন,“আমি তোমাদের কাছে এমন একটি কিতাব নাযিল করেছি যাতে তোমাদের কথা আছে,অথচ তোমরা চিন্তা-ভাবনা করো না।” (সূরা আল-আম্বিয়া,আয়াত : ১০) আহনাফ ছিলেন আরবি সাহিত্যে গভীর পারদর্শী ব্যক্তি। তিনি ভালো করেই বুঝতেন ‘যাতে শুধু তোমাদের কথাই আছে’ এ কথার অর্থ কি ? তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন,কেউ বুঝি তাকে আজ নতুন কিছু শোনালো। মনে মনে বললেন,আমার কথা আছে! কই কুরআন নিয়ে আসো তো,দেখি এতে আমার কথা কি আছে ? তাঁর সামনে কুরআন শরীফ আনা হলো,একে একে বিভিন্ন দল উপদলের পরিচিতি এতে পেশ করা হচ্ছে- “একদল লোক এলো,তাদের পরিচয় এভাবে পেশ করা হলো,তারা রাতের বেলায় খুব কম ঘুমায়,শেষ রাতে তারা আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহÑ খাতার জন্য মাগফেরাত কামনা করে।” (সূরা আয-যারিয়াত,আয়াত : ১৭-১৯) “আবার একদল লোক এলো,যাদের সম্পর্কে বলা হলো,তাদের পিঠ রাতের বেলায় বিছানা থেকে আলাদা থাকে,তারা নিজেদের প্রতিপালককে ডাকে ভয় ও প্রত্যাশা নিয়ে,তারা অকাতরে আমার দেওয়া রিযিক থেকে খরচ করে।” (সূরা হা-মীম-সিজদা,আয়াত : ১৬) “কিছুদূর এগিয়ে যেতেই তার পরিচয় হলো আরো একদল লোকের সাথে। তাদের সম্পর্কে বলা হলো,রাতগুলো তারা নিজেদের মালিকের সিজদা ও দাঁড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেয়।” (সূরা আল-ফোরকান,আয়াত : ৬৪) “অতঃপর এলো আরেকদল মানুষ,এদের সম্পর্কে বলা হলো,এরা দরিদ্র ও সচ্ছল উভয় অবস্থায় (আল্লাহ্র নামে) অর্থ ব্যয় করে,এরা রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে,এরা মানুষদের ক্ষমা করে,বস্তুত আল্লাহ তায়ালা এসব নেককার লোকদের দারুণ ভালোবাসেন।” (সূরা আলে-ইমরান,আয়াত : ১৩৪) “এবার এলো আরেকটি দল,তাদের পরিচয় এভাবে পেশ করা হলো,এরা (বৈষয়িক প্রয়োজনের সময়) অন্যদেরকে নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়,যদিও তাদের নিজেদের রয়েছে প্রচুর অভাব ও ক্ষুধার তাড়না। যারা নিজেদের কার্পণ্য থেকে দূরে রাখতে পারে তারা বড়ই সফলকাম।” (সূরা আল-হাশর,আয়াত : ৯) একে একে এদের সবার কথা ভাবছেন আহনাফ। এবার কুরআন তার সামনে আরেক দল লোকের কথা পেশ করলো,“এরা বড় বড় গুনাহ ও নির্লজ্জ অশ্লীলতা থেকে বেঁচে থাকে,যখন এরা রাগান্বিত হয় তখন (প্রতিপক্ষকে) মাফ করে দেয়,এরা আল্লাহর হুকুম আহকাম মেনে চলে,এরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে,এরা নিজেদের মধ্যকার কাজকর্মগুলোকে পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়। আমি তাদের যা দান করেছি তা থেকে তারা অকাতরে ব্যয় করে। ”(সূরা আশ-শুরা,আয়াত : ৩৭-৩৮) আহনাফ নিজেকে নিজে জানতেন। আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত এ লোকদের কথাবার্তা দেখে তিনি বলেন,“হে আল্লাহ্ তায়ালা,আমি তো এই বইয়ে আমাকে খুঁজে পেলাম না। আমার কথা কই ? আমার ছবিতো এর কোথাও আমি দেখলাম না,অথচ এ কিতাবে নাকি তুমি সবার কথাই বলেছো।” এবার তিনি ভিন্ন পথ ধরে কুরআনে নিজের ছবি খুঁজতে শুরু করলেন। এ পথেও তাঁর সাথে বিভিন্ন দল উপদলের সাক্ষাত হলো। প্রথমত: তিনি পেলেন এমন একটি দল,যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,“যখন তাদের বলা হয়,আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মা’বুদ নেই,তখন তারা গর্ব ও অহংকার করে এবং বলে,আমরা কি একটি পাগল ও কবিয়ালের জন্য আমাদের মা’বুদদের পরিত্যাগ করবো ?” (আস-সাফফাত : ৩৫-৩৬) তিনি আরো সামনে এগুলেন,দেখলেন আরেকদল লোক। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,“যখন এদের সামনে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়,তখন এদের অন্তর অত্যন্ত নাখোশ হয়ে পড়ে,অথচ যখন এদের সামনে আল্লাহ ছাড়া অন্যদের কথা বলা হয় তখন এদের মন আনন্দে নেচে ওঠে।”(সূরা আয-যুমা,আয়াত : ৪৫) তিনি আরো দেখলেন,“কতিপয় হতভাগ্য লোককে জিজ্ঞাস করা হচ্ছে,তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করলো? তারা বলবে,আমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করতাম না,গরীব মিসকিনদের খাবার দিতাম না। কথা বানানো যাদের কাজ আমরা তাদের সাথে মিশে সে কাজে লেগে যেতাম। আমরা শেষ বিচারের দিনটিকে অস্বীকার করতাম,এভাবেই একদিন মৃত্যু আমাদের সামনে এসে হাযির হয়ে গেল।” (সূরা আল-মোদ্দাসসির,আয়াত : ৪২-৪৬) আহনাফ কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ধরণের মানুষের বিভিন্ন চেহারা ছবি ও তাদের কথা দেখলেন। বিশেষ করে শেষোক্ত লোকদের অবস্থা দেখে মনে মনে বললেন,“হে আল্লাহ্ এ ধরণের লোকদের ওপর আমি তো ভয়ানক অসন্তুষ্ট। আমি এদের ব্যাপারে তোমার আশ্রয় চাই। এ ধরণের লোকদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।” তিনি নিজেকে ভালো করেই চিনতেন,তিনি কোনো অবস্থাতেই নিজেকে এই শেষের লোকদের দলে শামিল বলে ধরে নিতে পারলেন না। কিন্তু তাই বলে নিজেকে প্রথম শ্রেণির লোকদের কাতারেও শামিল করতে পারছেন না। তিনি জানতেন,আল্লাহ তায়ালা তাকে ঈমানের দৌলত দান করেছেন। তার স্থান যদিও প্রথম দিকের সম্মানিত লোকদের মধ্যে নয়,কিন্তু তাই বলে তার স্থান মুসলমানদের বাইরেও তো নয়। তার মনে নিজের ঈমানের যেমন দৃঢ় বিশ^াস ছিল তেমনি নিজের গুনাহ্ খাতার স্বীকৃতিও সেখানে সমানভাবে মওজুদ ছিল। কুরআনের পাতায় তাই এমনি একটি ছবির সন্ধান তিনি করছিলেন,যাকে তিনি একান্ত নিজের বলতে পারেন। তার সাথে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও দয়ার প্রতি তিনি ছিলেন গভীর আস্থাশীল। তিনি নিজের নেক কাজগুলোর ব্যাপারে যেমন খুব বেশি অহংকার ও আশাবাদী ছিলেন না,তেমনি আল্লাহ্ তায়ালার রহমত থেকেও তিনি নিরাশ ছিলেন না। কুরআনের পাতায় তিনি এমনি একটি ভালো-মন্দ মেশানো মানুষের ছবিই খুঁজছিলেন এবং তার একান্ত বিশ^াস ছিল এমনি একটি মানুষের ছবি অবশ্যই তিনি এই পুস্তকের কোথাও না কোথাও পেয়ে যাবেন। কেন,তারা কি আল্লাহর বান্দাহ্ নয় যারা ঈমানের ‘দৌলত’ পাওয়া সত্ত্বেও নিজেদের গুনাহ্র ব্যাপারে থাকে একান্ত অনুতপ্ত,আল্লাহ তায়ালা কি এদের সত্যিই নিজের অপরিসীম রহমত থেকে মাহরুম রাখবেন ? এই কিতাবে যদি সবার কথা থাকতে পারে তাহলে এ ধরণের লোকদের কথা থাকবেনা কেন ? এই কিতাব যেহেতু সবার,তাই এখানে তার ছবি কোথাও থাকবেনা- এমনতো হতেই পারেনা। তিনি হাল ছাড়লেন না। এ পুস্তকে নিজের ছবি খুঁজতে লাগলেন। আবার তিনি কিতাব খুললেন। কুরআনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক জায়গায় সত্যিই আহ্নাফ ‘নিজেকে’ আবিষ্কার করলেন। খুশিতে তার মন ভরে উঠলো,আজ তিনি কুরআনে নিজের ছবি খুঁজে পেয়েছেন,সাথে সাথেই বলে উঠলেন,হ্যাঁ এই তো আমি। “হ্যাঁ,এমন ধরণের কিছু লোকও আছে যারা নিজেদের গুনাহ্ স্বীকার করে। এরা ভালো মন্দ মিশিয়ে কাজকর্ম করে,কিছু ভালো কিছু মন্দ। আশা করা যায় আল্লাহ্ তায়ালা এদের ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহ্ বড়ো দয়ালু বড়ো ক্ষমাশীল।” (সূরা আত-তাওবা,আয়াত : ১২) আহনাফ আল্লাহ্র কিতাবে নিজের ছবি খুঁজে পেয়ে গেলেন,বললেন,হ্যাঁ এতোক্ষণ পর আমি আমাকে উদ্ধার করেছি। আমি আমার গুনাহের কথা অকপটে অস্বীকার করি,আমি যা কিছু ভালো কাজ করি তা আমি অস্বীকার করিনা। এটা যে আল্লাহ্র একান্ত দয়া তাও আমি জানি। আমি আল্লাহ্র দয়া ও রহমত থেকে নিরাশ নই। কেননা এই কিতাবই অন্যত্র বলেছে,“আল্লাহ্র দয়া থেকে তারাই নিরাশ হয় যারা গোমরাহ্ ও পথ ভ্রষ্ট।” (আল-হিজর : ৫৬) আহনাফ দেখলেন,এসব কিছুকে একত্রে রাখলে যা দাঁড়ায় তাই হচ্ছে তাঁর ছবি’। কুরআনের মালিক আল্লাহ্ তায়ালা নিজের এ গুনাহ্গার বান্দার কথা তাঁর কিতাবে বর্ণনা করতে সত্যি ভুলেননি। আহনাফ কুরআনে পাঠকের কথার সত্যতা অনুধাবন করে নীরবে বলে উঠলেন হে মালিক,তুমি মহান,তোমার কিতাব মহান,সত্যিই তোমার এ কিতাবে দুনিয়ার গুনী-জ্ঞানী,পাপী-তাপী,ছোট-বড়ো,ধনী-নির্ধন,সবার কথাই আছে। তোমার কিতাব সত্যিই অনুপম। এই ছিল আহনাফের নিজেকে আবিষ্কারের গল্প। তিনি নিজেকে খুঁজে পেলেন মহান রবের কিতাবে। এ গল্প থেকেই আল-কুরআন সম্পর্কে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গী আমার সামনে ভেসে উঠে। আবার পুরোদমে কুরআন অধ্যয়ন শুরু করলাম। পড়ে ফেললাম বেশ কয়েকখানা তাফসিরগ্রন্থ। সন্ধান পেলাম বেশ কিছু দল-উপদলের। তবে সেগুলো মূলত,চিন্তা-আদর্শ ও কর্মভিত্তিক দল-উপদল। আল-কুরআন যাদের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছে।
বইয়ের নাম | আল – কুরআন আমাদের কথা বলে |
---|---|
লেখক | মাহমোদ মুস্তফা |
প্রকাশনী | বিন্দু প্রকাশ |
সংস্করণ | |
পৃষ্ঠা সংখ্যা | |
ভাষা |